১৯ নভেম্বর ২০২৩


সবুজের মায়ায় ঘেরা শীতের সিলেট

চারপাশে সবুজের হাতছানি। চা পাতায় জমে থাকে ভোরের কুয়াশা। আঁকাবাঁকা পথ, ছোট-বড় টিলা, ঘন সবুজ বন- সবকিছুই চোখ শীতল করে। সিলেটের বিভিন্ন চা বাগান ও অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র নিঃসন্দেহে হৃদয় হরণ করে। ছবি : সংগৃহীত

শেয়ার করুন

 

 

রেবেকা নদী ( অতিথি প্রতিবেদক) : সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। সবুজ চা বাগান, পাহাড়, নদী-ঝরনা, টিলা আর দিগন্তজোড়া সবুজ বৃক্ষ, নীল আকাশের নিচে অপরূপ মায়াবী আভা সিলেটকে করেছে রূপের রানি। এ সৌন্দর্য আর নতুন রঙের আলপনা যেকোন ভ্রমণপিপাসু মানুষকে সিলেটে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। হজরত শাহজালাল (র.)-এর পুণ্যভূমি, মরমি কবি হাছন রাজা, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম, আলী আমজাদের ঘড়ি আর ক্বিনব্রিজের স্মৃতিবিজড়িত সিলেট তো প্রকৃতিপ্রেমীদের হাতছানি দিয়ে ডাকবেই। অনুপম সৌন্দর্যে ভরপুর কোলাহলমুক্ত পরিবেশ, কোথাও সবুজ ক্ষেত, নিবিড় অরণ্য আবার কোথাও সুউচ্চ পর্বতমালা দেখে আনমনা হয়ে যে কেউ গেয়ে উঠতে পারেন— ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমিসকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি…’।

আরও পড়ুন : আজ ও কাল সিলেটসহ দেশজুড়ে বিএনপির হরতাল

শীতে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। যাব যাব করে যাওয়া হচ্ছিল না। একদিন সেই শুভক্ষণ এলো। ঠিক করলাম শ্রীমঙ্গল যাব। উত্তরা থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে রওনা হয়েছি সায়েদাবাদের উদ্দেশে। পৌঁছলাম রাত সাড়ে ৯টায়। ঢাকার জ্যামের কথা আর কী বলব! সে যাইহোক। এরপর রাত ১১টা ৩০ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশে সায়েদাবাদ থেকে বাস ছাড়ল। আমরা তো ভীষণ খুশি। বন্ধুরা মিলে গান গাইতে গাইতে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে গেলাম। তারপর তন্দ্রা লাগল। চোখ খুলেই দেখি পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত স্থানে। তখন ঘড়ির কাঁটায় ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট। উফ্‌ কী শীত! মোটা জ্যাকেটের ওপর শাল জড়িয়ে নিলাম।

আরও পড়ুন : মধ্যনগরে প্রাচীন কৃষিউপকরণ ‘মইয়ের’ জমজমাট হাট

চায়ের রাজধানী বলে খ্যাত দেশের অন্যতম নৈসর্গিক সৌন্দর্যময় এক উপজেলা সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল। বাংলাদেশের অপূর্ব দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম এ শ্রীমঙ্গল। ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান উঁচু-নিচু টিলাসমৃদ্ধ এ উপজেলার। এর আয়তন ৪২৫.১৫ বর্গকিলোমিটার। এ উপজেলায় দেশের সবচেয়ে বেশি চা বাগান। ঋতুভেদে প্রকৃতির অপূর্ব লীলা ধরা দেয় এখানে। তাই এখানে পর্যটকের ভিড় সব সময় লেগেই থাকে। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে সিলেটের প্রথম আকর্ষণ চা বাগান। বাংলাদেশের মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেটে। এর মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান।

আরও পড়ুন : নির্বাচন করতে চান না সিলেট-৫ আসনের বর্তমান এমপি হাফিজ মজুমদার

মালিনীছড়া চা বাগান : উপমহাদেশের প্রাচীনতম চা বাগানগুলোর অন্যতম মালিনীছড়া রয়েছে সিলেটে। ১৮৫৪ সালে লর্ড হার্ডসন ১ হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই চা বাগানটি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত। প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিস্বত্ব সীমানায় উঁচু-নিচু টিলার পর টিলায় ভরা চা বাগানটি।

 

রয়েছে এক হাজার ২০০ একর জমির ওপর অনিন্দ্য চা বাগান, রাবার আবাদের জন্য ৭০০ একর জমি এবং কারখানা, আবাসন, বৃক্ষ, বনজঙ্গল জুড়ে বাকি জমিটুকু। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে এসে যাঁরা অল্প সময়ে খুব সুন্দর কোনো সবুজের গালিচায় হারিয়ে যেতে চান, তাঁদের জন্য অনন্য স্থান মালিনীছড়া চা বাগান। দেশের মোট চায়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এ জন্য সিলেটকে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশও বলা হয়।

 

সিলেটের চা বাগানে ঢোকার পর মাথার ওপর বড় বড় ছায়াবৃক্ষ। নিচে আধো আলো, আধো ছায়ার সবুজ চাদর দেখে যে কারও মনে হবে এ যেন শৈল্পিক কারুকাজ। সিলেটের চা বাগানের এ প্রাকৃতিক দৃশ্য পর্যটকের মন ছুঁয়ে যায়। ১ হাজার ৫০০ একর জায়গার ওপর অবস্থিত উপমহাদেশের প্রথম চা বাগান মালিনীছড়ায় পর্যটকদের কাছে আরেক বিস্ময়।

আরও পড়ুন : ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে মৌলভীবাজারে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

সিলেটের চায়ের রং, স্বাদ এবং সুবাস অতুলনীয়। বর্তমানে বেসরকারি তত্ত্বাবধানে চা বাগান পরিচালিত হয়ে আসছে। চা বাগানের পাশাপাশি বর্তমানে এখানে কমলা ও রাবারের চাষ করা হয়। এ বাগানের পাশেই বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্টেডিয়াম। চা বাগানের বুক ভেদ করে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক।

আকাশপথে যারা সিলেটে আসেন, তাদের প্রথমেই স্বাগত জানায় এ চা বাগান। বাগানটির অদ্ভুত সুন্দরের মায়ায় পড়েছিলেন অনেক বিদেশি। গাড়ি থামিয়ে তারা দাঁড়িয়েছেন বাগানের পাশে। বাগানে হাঁটলেই চোখে পড়বে কমলা, কাঁঠাল ও সুপারি বাগান। এ ছাড়া ট্যাং ফল, আগর, রাবার, চন্দনসহ অনেক ঔষধি-শোভাবর্ধক বৃক্ষ রয়েছে বাগানটিতে।

আরও পড়ুন : এই শীতে ঘুরে আসুন বাংলার নীলনদ ‘লালাখাল’

সিলেট বিভাগের সর্বত্রই কোথাও না কোথাও রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র। যে স্থানগুলোর জন্য এই বিভাগ পর্যটকদের পছন্দের শীর্ষে সেগুলো হল— জাফলং, হজরত শাহজালাল (রা.) ও হজরত শাহ পরান (রা.)-এর মাজার শরিফ, জৈন্তাপুর, মাধবকুণ্ড ও পরীকুণ্ড জলপ্রপাত, শ্রীমঙ্গল, লালাখাল, তামাবিল, হাকালুকি হাওর, ক্বিনব্রিজ, ভোলাগঞ্জ,বিছনাকান্দি,রাতারগুল, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের বাড়ি, হাছন রাজা জাদুঘর, মালিনীছড়া চা বাগান, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, আলী আমজাদের ঘড়ি, মণিপুরি রাজবাড়ি, মণিপুরি মিউজিয়াম, শাহি ঈদগাহ, ওসমানী শিশুপার্ক,

হামহাম জলপ্রপাত, সাতছড়ি অভয়ারণ্য, রেমা উদ্যান, এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং, মির্জাপুর ইস্পাহানি চা বাগান, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শাহ আবদুল করিমের বাড়ি, সুনামগঞ্জ শহরে হাছন রাজা মিউজিয়াম। মাধবপুর লেক ও হামহাম জলপ্রপাত পার্শ্ববর্তী উপজেলায় হলেও পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করেই এসব স্থান দেখতে যান।

 

আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা : শ্রীমঙ্গলে খাওয়া-দাওয়া ও আবাসন ব্যবস্থা ভাল। পর্যটকরা শ্রীমঙ্গলে অবস্থান করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশি। দেশি-বিদেশি পর্যটক শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়ি, মাইক্রোবাস, সিএনজি-অটোরিকশা নিয়ে সহজেই পর্যটন স্পটগুলো ঘুরে বেড়াতে পারেন। বিদেশিদের মধ্যে অনেকেই বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পর্যটন স্পটগুলোর উদ্দেশ্যে। সব পর্যটন স্পটে যাওয়ার জন্য আছে সুন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা। যানবাহনেরও নেই কমতি। ইকো-গাইডরাও প্রস্তুত আপনাকে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। থাকার জন্য রয়েছে অত্যাধুনিক আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ ও বাংলো। খাবারের জন্য রয়েছে ভালো ও উন্নতমানের রেস্তোরাঁ।

এএস // আতারা

শেয়ার করুন