১৪ ডিসেম্বর ২০২৩
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : ভারতীয় চিনি পাচারে সুনামগঞ্জের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে চোরাকারবারি সিন্ডিকেট। প্রতিদিনই জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে দেদারসে চিনি আসছে দেশে। এতে করে চোরাকারবারি ও কিছু ব্যবসায়ী লাভবান হলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সীমান্তে চোরাকারবার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা দেখা গেলেও কোনোভাবেই থামছে না সিন্ডিকেটের কারসাজি। চোরাইপথে আনা এসব চিনি প্রতিদিন রাত ১২টার পর সুনামগঞ্জের পৌর শহর দিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
সুনামগঞ্জের বৈঠাখালী এলাকার সুরমা নদীর ওপর আব্দুজ জহুর সেতু নির্মাণের পর বদলে যায় এই অঞ্চলের অর্থনীতি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই সেতুর ওপর দিয়ে লক্ষাধিক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছালেও রাত ১২টার পর থেকে বদলে যায় এই সেতুর চিত্র। নীরবতা ও অন্ধকার পুঁজি করে প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ভারতীয় চিনি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
চারদিকে ভিড় করেছে ঘনকোয়াশা। রাত বাজে ১২টা ১০ মিনিট। দ্রুত গতির সারি সারি ট্রাকের হেডলাইটের আলোয় আলোকিত আব্দুজ জহুর সেতু। ট্রাকের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখা গেলো পলিথিনে মোড়ানো ট্রাকভর্তি ভারতীয় চিনি। এগুলো নিয়ে সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়কের দিকে যাচ্ছে চোরাকারবারিরা।
আব্দুজ জহুর সেতু থেকে ঠিক ২ কিলোমিটার দূরে রাধানগর পয়েন্ট। সেই পয়েন্টে যেতেই অন্ধকারের মধ্যে মালভর্তি একটি ট্রাকে চোখে পড়ল জাগো নিউজের প্রতিবেদক লিপসন আহমেদের। তিনি তার প্রতিবেদনে লিখেন, ‘ট্রাকের সামনে কয়েকজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে গিয়ে ক্যামেরা অন করতেই দেখা যায় কয়েকজন পুলিশ সদস্য। সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়েই ট্রাক রেখে দৌড়ে পালিয়ে যান তারা।
ট্রাকচালক শিবুল জানান, গাড়িতে ভারতীয় চিনি আছে। সেগুলো জেলার জাওয়া বাজার এলাকায় যাবে। পুলিশ ট্রাক আটকে টাকা দাবি করেছিল, পরে আপনাদের দেখে চলে গেছে।
এদিকে রাধানগর পয়েন্ট থেকে আরও ৩ কিলোমিটার দূরে চালবন পয়েন্ট। সেখানে গিয়ে চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশে পুলিশের চেকপোস্ট বক্স বসানো। তবে সেখানে দায়িত্বরত কোনো পুলিশ সদস্যকে পাওয়া যায় নি।
চালবন পয়েন্ট থেকে আরও ৫ কিলোমিটার দূরে বিশম্ভরপুর উপজেলার পলাশ বাজারে দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে চায়ের ব্যবসা করেন করম আলী। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখেন তিনি। তার চায়ের দোকানে প্রতিনিয়ত থাকে লোক সমাগম। তবে রাত ১২টার পর থেকে তার বেচাকেনা জমে ওঠে।
করম আলী জানান, শুধু পলাশ বাজার দিয়ে চোরাকারবারিরা ভারতীয় চিনি রপ্তানি করে না, এই উপজেলার অন্য সড়ক দিয়েও প্রতিদিন ভারতীয় চিনি বের হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে।
করম আলীর মতো বাজারে থাকা স্থানীয় বাসিন্দারাও জানালেন, প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে কোটি কোটি টাকার চিনি-আলু দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।’
প্রতিদিন রাত ১২টার পর ধনপুর, চিকারকান্দি, বাঘবেড়, চেংবিল, শরীফগঞ্জ, মতুরকান্দিসহ বেশ কয়েকটি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৮ থেকে ১০ ট্রাক চিনি বের করে চোরাকারবারিরা। প্রতিটি গাড়িতে ৩০০ বস্তা করে ভারতীয় চিনি থাকে। পরে রাধানগর এলাকায় এসে পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে সেসব চিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছেন তারা। সেইসঙ্গে চোরাকারবারিদের একটি চক্র মোটরসাইকেল মহড়ায় এসব অবৈধ ভারতীয় চিনির ট্রাক সুনামগঞ্জ পৌর শহরের প্রবেশ মুখ হাসনরাজা তোরণ পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছে।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ভারতীয় চিনি চোরাকারবারি সাইফুল বলেন, সীমান্ত এলাকায় ২০ থেকে ২২ জন ব্যবসায়ী চোরাই পথে চিনি নিয়ে এসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার করছে। যার ভাগ সবাই পায়।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জ আব্দুজ জহুর সেতুর ওপর থেকে ২৯৮ বস্তা ভারতীয় চিনি নিয়ে যাওয়া একটি ট্রাক স্থানীয় সাংবাদিকরা আটক করে পুলিশকে খবর দিলে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে এসে ট্রাকটি জব্দ করে থানায় নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ রিপোর্টাস ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান বলেন, সুনামগঞ্জের সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়ত ভারতীয় অবৈধ পণ্য যাচ্ছে, এদিকে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো উচিৎ।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ্ বলেন, চোরাচালানের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্য জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’